গল্প 

কলমি ।। তাইবা তুলবি

একটি ছোট্ট মেয়ে, তার নাম কলমি। ক্লাস টু-তে পড়ে। দেখতে মিষ্টি হলেও চুপচাপ গোছের সে নয়। বুদ্ধিমতী এবং বেশ পাকা কথাবার্তা।
সে হাঁটছে তার মন যেদিকে যেতে চাইছে। স্কুল ড্রেস পড়ে হাঁটছে মুক্ত পাখির ডানার মতন উড়ু মনে। দু’পাশে গাছ মাঝে রাস্তা, ঠান্ডা হাওয়া। সাদা ফিতায় তার চুল দুলছে।
অপরিচীত রাস্তায় তার হাঁটতে মোটেও দ্বিধা হচ্ছে না। স্কুল একটা জেলখানা। পোশাক পরে কয়েদিরা যেমন যায় ঠিক তেমনই, মনে মনে ভাবে কলমি।
আজ সে স্কুলে যাবেই না। স্কুলে যেতে তার একদমই ভালো লাগে না। আজ সে হাঁটবে। স্কুল চুরি করবে।
হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে চলে এসেছে কলমি।
এদিকটাই ধূলোবালি অনেক কম। বুক ভরা শ্বাস নিতে দারূণ লাগছে তার। এতো দূরে এসেও ভেতরে ভয়ের এতটুকুও সঞ্চার হয়নি। বাসায় ফেরার চিন্তা তার মন করছে না।
চঞ্চল ভাবনা ক্রমশ কলকলিয়ে উঠছে ভেতরে, মা-বাবা কেন যে প্রতিটা দিন স্কুলে পাঠায়। মাঝেমাঝে এমন হাঁটতেও তো দিতে পারে। মনমত নতুন নতুন রাস্তা, দোকান, গাছপালা দেখবো। সবসময় একই জিনিস দেখতে ভালো লাগে নাকি! এমন চলতে থাকলে তো আমার মানসিক বিকাশও হবে না।আজ স্কুলে যাবোই না। কাল বলবো সবাইকে আমি কত মজা করেছি। কত কিছু খেয়েছি।
অনেক্ষণ হাঁটার পর,পথে একটা পাগল দেখতে পায় কলমি।লোকটি বসে আছে একটা ফুটপাতের উপরে চাদর বিছিয়ে। পাশে একটা ছোট্ট ব্যাগও আছে। একটু পর পরই তার নোংরা নখ দিয়ে পায়ের তালু চুলকাচ্ছে।
কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে একটা আবেগ উদ্রেক হল কলমির ভেতরে। আবেগের শীতল জল ফোটা ফোটা করে পড়ছে তার বুকে।
“পাগলদের কি কিছুই মনে থাকে না!”
তবে, তার নাকে একটা রহস্যের গন্ধ লাগছে যে, পাগল হওয়া একটা আজগুবি ব্যাপার।
কাকতালীয়ভাবে মায়ের মুখে যে পাগলের কথা শুনেছে সে পাগল আর এ পাগল হুবহু একই রকম। নোংরা দাঁত, পোশাক কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া, অপরিষ্কার চুল ধুলো-বালিতে গিট দেয়া কেমন যেন মনে হয় পাগলটার জীবনের স্মৃতির সকল জট ওই চুলেই পাকানো। অনেকদিন শ্যাম্পু তেল না দিলে হয়তো চুল এমনটাই হওয়ার কথা। 
কলমির দেখে অস্বস্তি বোধ হলো। পাগলটা তাকে দেখে হাসছে। তার কেমন অদ্ভুৎ লাগলো।
কিছুক্ষণ আনমনে কি ভেবে বিড়বিড় করে আবার ব্যাগ কাঁধে হেলেদুলে চলছে কলমি। গাছ-পালা আর রাস্তা দেখতে দেখতে সে এতোদূর এসেছে যে বাড়ি আর স্কুল কোনদিকে সে নিজেই সবটা যথাযথভাবে গুলিয়ে ফেলেছে। সবকিছু বড্ড অচেনা। এখন বাড়ি হেঁটে চেনা একদমই অসম্ভব। তবুও তার খুব আনন্দ হচ্ছে। যত নতুন রাস্তা দেখছে তার মজাও যেন বেশি লাগছে। দুপুরের সাথে সাথে গরমও বাড়তে শুরু হলো।
এদিকটাই গাছও কেমন কমে এসেছে। ঠান্ডা হাওয়া থেমে এসেছে। পাশে একটা আইসক্রিমের ভ্যান দেখে উত্তেজিত বোধ করলো কলমি।
বরফ আইসক্রিম দেখেই দ্রুত পকেটে টাকা আছে কিনা খুঁজতে ব্যস্ত। পকেট হাতিয়ে কেমন হতাশা নেমে এলো তার মুখে। মাত্র পাঁচ টাকার একটা পয়সা আছে।
আইসক্রিমওয়ালার পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।বরফ ঘষে ঘষে সাদা সাদা গুড়োগুলো নিচে জমা হচ্ছে। কি সুন্দর দেখতে। আরও দারুণ লোভ লাগে যখন সাদা হলদে মিল্ক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয় হাতের খুব কৌশলে। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লাল, হলুদ, সবুজ, কমলা ফ্লেভার। দেয়ার সময় কি লালসা জাগে। এই রৌদে রঙ্গিন আইসক্রিমটাই রঙ্গিন স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে তার। তাছাড়া স্কুলের পাশেরটার চেয়ে এটা বেশ জমকালো। এরকমটা ওদিকে পাওয়া যায় না। তাই এটার দাম দশ টাকা।
“পাঁচটাকা দামের নেই, আঙ্কেল?”
আইসক্রিম বিক্রেতা আইসক্রিম ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দ্রুত বলে দিলো, “না”।
“কেমন লোক, একটা এমনিতেই তো দিতে পারে কত বরফ ওখানে।” কলমী জোরালো প্রতিক্রিয়া করে, কিন্তু মনে মনে।
“এরা এমন কেন। একটা পাঁচটাকা দিয়ে দিলে তার এমন কি হতো।”
আবারও সে হাঁটছে হেলেদুলে।
মন বলছে একটু আগে ঝালমুড়িটা না খেয়ে বোধহয় আইসক্রিম খেলে ভালো হতো।
পানির বোতলটা বের করে খেয়ে খেয়ে হাঁটতে লাগলো কলমি। তার অস্বস্তি হচ্ছে। বাড়িও তো যেতে হবে। প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেলো। ভাবতে লাগলো ভালোই হয়েছে সে আইসক্রিম খায়নি বাস একটা নিয়ে চলে যেতে পারবে স্কুল গেটে। কিন্তু বাসও তো চেনা না কোনটাতে উঠবে কত নম্বরে উঠতে হবে।
তার মা-বাবা কোনোদিন তাকে  দূরে একা যেতে দেয়নি।বন্ধুদের সাথেও খেলতে দেয় না তেমন। তার মনটা অন্ধকার হয়ে এলো ক্ষণেই।
কাউকে জিজ্ঞাসা করলে ভালো হবে কিনা সেটা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়তে হলো। মা বলেছে ছেলে ধরা থাকে রাস্তায়। যদি ওরা তাকে ভুল জায়গা বলে তুলে নিয়ে যায়!
পানির ঢোক গিলে কর্ক ঘোরাতে ঘোরাতে এদিক ওদিক দেখলো কলমি কাউকে যদি পায়। কিন্তু সুবিধের কাউকে মনে হচ্ছে না। কেমন ভয় করছে তার। কারণ মা আরও বলেছে তাদের দেখে নাকি ভালোই মনে হয়। ভালো হওয়ার ছদ্মবেশ ধারণ করে।
পেছনে একটু দূরেই দেখলো সেই পাগল লোকটি। প্রায় অনেকক্ষণ হচ্ছে সে লোকটিকে দেখেছিলো। পা খুব জোরেই চলে লোকটির।
কলমি হাঁটছে আবারও তার মতন। কিন্তু  মিনিট খানেক পর হঠাৎ সে টের পেল ওই পাগল লোকটা আসলে তার পিছু নিয়েছে।
পাগলদের দেখতেই বিৎঘুটে তার উপর পিছু নিয়েছে। কলমি এবার প্রচন্ড রকমের ভয় পেলো। কিন্তু তাও সে নিজের মতন হেঁটে যাচ্ছে এবং বোঝার চেষ্টা করছে।
তার শুধু মনে পড়ছে ছেলেধরাদের গল্প। কীভাবে তারা ছোটদের চকলেট খাইয়ে, বেহুশ করে, জনশূণ্য জায়গা থেকে তুলে নিয়ে যায়। মনে মনে একটু আফসোস বোধও হল সে বড় হলে হয়তো সমস্যাটা হত না।
লোকটি তার পিছু পিছু হেঁটেই চলেছে। কি করবে কলমি ঠিক করতে পারছে না। খানিক পথ হেঁটে বুকে সাহস নিয়ে বোতল চেপে ধরলো দুহাতে। পাগল লোকটির বিৎঘুটে মুখ তার দেখতেই কেমন লেগেছে কিন্তু তাও এবার সে কথা বলবে, বলতেই হবে। কলমি চাপানো বোতল হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। গলা বড় করে সন্দেহের চোখে বলল,
আপনি কি ছেলেধরা?
পাগলটি তার নোংরা দাঁত একেবারে স্পষ্ট দেখিয়ে একটা হাসি দিলো,
-হে,,,হে,, ছেলেধরা কেন হবো? আমি তো তোমার বন্ধু। বেশ পাকা মেয়ে তো তুমি।
কলমি ভ্রু কুচকিয়ে আগাগোড়া লোকটির গায়ে চোখ বুলিয়ে নিলো,
“আপনি আমার পেছন পেছন হাঁটছেন কেন?”
লোকটা বলল,”আসলে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। তুমিও কি পথ হারিয়ে ফেলেছো? তোমার স্কুল কোথায়?”
“না, পথ হারাবো কেন। ওই যে সামনে একটা স্কুল দেখছেন ওটা আমার।”
কলমি আবার মুখ সামনে ফিরিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকলো। পাগল লোকটাও তার পেছন পেছন হাঁটছে। কলমির চঞ্চল মন এখন সন্দেহের গভীরে। এ ছদ্মবেশী পাগল আসলে একটা ছেলেধরা।
কলমির দু’চোখে সাহস ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তাও সে তার মুখকে কঠিন করে রেখেছে। তার সাদা সাদা পা দু’টো পুরোদমে হাঁটছে। লোকটির মুখ দেখে এটা নিশ্চিত ভাবা যায় এই পাগলটা তাকে তুলে নিয়ে যাবেই এবং এ বিষয়টি সে নিশ্চিৎ করতে পেরেছে। চারিদিকে রৌদের আলো বেড়ে চলেছে।
উষ্ণতা বেড়ে চলেছে চকচকে দুপুরের রাস্তায়। ঠিক তেমনই জ্বলজ্বল করছে পাগল লোকটির চোখদু’টো।
দ্রুত হেঁটে রাস্তা পার হয়ে স্কুল গেটে দাঁড়ালো কলমি। স্কুলে টিফিন ছুটি দিয়েছে। কিন্তু তার তো স্কুল ইউনিফর্ম মিলছে না। এবার!!!!!
গেটে এভাবে দাঁড়াবার অনুমতিও নেই। দাঁড়োয়ান ধরবে তাকে। এই রোদে এভাবে তাকে সহ্য করা যায় না বিশেষত যখন লোকটা রাস্তার অপর পার থেকে তার দিকে চেয়ে আরও বিৎঘুটে ভাবে হাসছে।
কলমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবলো মনে মনে। রোদেলা দুপুর তার বড্ড অপছন্দ। দাঁড়িয়ে থেকে এভাবে ভাবাটাও বিরক্তিকর। বুদ্ধির কলিতে এবার ফুল ফোটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কলমি।
বোতলের পানি নেড়ে নেড়ে কত ভাবনা খেলছে তার মন। তার কাছে এমন কিছুই নেই যেটা আজ তাকে বাঁচাবে। কোনো বাহানা, কোনো আজগুবি গল্পও নেই। ভূত, পাগল, ছেলেধরাদের যে গল্প মা শোনাতো আজ সেটাই বাস্তবে হচ্ছে। শুধু ব্যবধান হল রাত আর দিনে। এই রোদ যেন রাতের মতনই ভয়ানক অস্থির করা।
স্কুলে পড়াশোনায় মোটামুটি ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট কলমি।
তবে বুদ্ধিতে তার অল্প-স্বল্প সুনাম আছে। লুকিয়ে সে নিজের সুনাম কয়েকবার শুনেছে কোকিল ম্যাডাম ও মায়ের আলাপে।
পাগলটা অনেক্ষণ ধরে চেয়ে আছে কলমির দিকে।
কলমির আতঙ্ক পাগল লোকটি বোধহয় অল্প টের পাচ্ছে।মিনিটেই কলমিকে তার ব্যাগ খুলতে দেখলো। হাতে কি একটা যেন নিয়ে রাস্তা পার হবে বলে এপাশ ওপাশ দেখছে সে।
পাগল লোকটি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। মেয়েটা করছেটা কি! রাস্তা পার হয়ে তার দিকে এসে দাঁড়ালো কলমি।
পাগল লোকটি কিছু ধরতে পারলো না। ছোট্ট সূচের মতো কি যেন এর মতলব কি হতে পারে!
কলমির হাতে আসলে একটা কম্পাস। আশেপাশে একবার তাকালো কলমি। সকলে যার যার কাজে ব্যস্ত। পথিকেরা তার দিকে কেও বিশেষ নজর দিয়ে নেই পাগল লোকটি বাদে।
কলমি লোকটার দিকে চেয়ে কম্পাসটা দিয়ে নিজের বাঁ হাতে হালকা আঁচড় দিয়ে উ…আ….চিৎকার করে, লোক জমিয়ে ফেললো। পাগল লোকটা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না, কি হচ্ছে!!!
লোকজনের ভিড়ে কলমি আতঙ্কের স্বরে বললো,
এটি আমার স্কুল নয়, আমি সিটি গভঃ স্কুলের ছাত্রী। এই লোকটা আমাকে ওখান থেকে তুলে এনেছে।
পাগল লোকটি এবার বড় বড় চোখ করে দিলো। এতোটা হয়তো সে কখনোই আশা করেনি। গণপিটুনির ভয়ে তার শরীর কেমন দুর্বল হয়ে আসছে। কোনো অপরাধ তো করেনি এখনো!
“আমাকে প্লিজ আমার স্কুল গেটে পৌঁছে দিন।”
কলমিকে দেখে পাগলটির মন কি ভাবছে সেটা এখন কলমির আর না ভাবলেও চলবে।
লোকজন পাগল লোকটাকে ধোলাই তো দিলোই। স্কুল চুরি করে মজাও করা হল। স্কুলে তার পাকামোর জন্য সবার বাহ্-বাও পেলো। স্কুলে এখন সে সেলিব্রিটি।

Related posts